রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের বুক বরাবর গুলি ছোড়ে পুলিশ ১৬ জুলাই, ২০২৪। গণঅভ্যুত্থানের মোড় ঘোরানো সেই ঘটনা– একদিকে আবু সাঈদের অমিত সাহস; অন্যদিকে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশি বর্বরতা। সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। চব্বিশের অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের স্মারক ঘটনার প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে গত বুধবার এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা, হত্যাকাণ্ড অনেক প্রশ্ন ও সংশয় সামনে নিয়ে এসেছে।
গোপালগঞ্জে সহিংসতা তৈরি করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সরবে তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করল। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে যারা ছিল, এ যাবৎ তাদের কারও মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার চিহ্নমাত্র দেখা যায়নি। তাদের অনেকে বরং প্রবাস থেকে উস্কানিমূলক বার্তা প্রচার করছেন। একই ধারাবাহিকতায় গোপালগঞ্জের আওয়ামী নেতাকর্মীরা সেখানে এনসিপির জনসভায় বাধা দেবার উদ্যোগ নেয়।
কেন অভ্যুত্থানজয়ী উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতাদের সংগঠন এনসিপি গোপালগঞ্জে সমাবেশ করতে পারবে না? এই প্রশ্নের সদুত্তর যেমন আওয়ামী নেতাকর্মীদের কাছে নেই; তেমনি শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর দিনটিতেই কেন গোপালগঞ্জে সমাবেশ করতে হলো এনসিপিকে– এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আরও প্রশ্নের অবতারণা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে অন্যান্য জেলায় এনসিপির চলমান কর্মসূচি ‘পদযাত্রা’ হলেও গোপালগঞ্জে সেটা ‘মার্চ’ অভিহিত করবার কারণ কী? অনুতাপহীন আওয়ামী নেতাকর্মীকে উস্কে দেওয়াই যদি এর কারণ হয়; তাহলে একে গণতান্ত্রিক চিন্তা বলা যায় না। যেখানে সংঘাত হবার আশঙ্কা, সেখানে সংযম অবশ্যই প্রয়োজনীয় ছিল।
২.
গোপালগঞ্জে অভ্যুত্থানজয়ী ছাত্রনেতারা মঞ্চ থেকে মুহুর্মুহু ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিলেন। এই স্লোগান চব্বিশের আন্দোলনের কোনো পর্যায়েও উচ্চারিত হয়নি। এখন এসে কোন অর্থে এই স্লোগান ব্যবহার করলেন এনসিপি নেতারা; কোনো ব্যাখ্যা তারা দেননি। গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবের বাড়ি, তাই সেখানে গিয়ে এই স্লোগান দেওয়া? মুজিববাদ এ দেশের সংবিধানে বা রাজনীতিতে কখনও নিজের উপস্থিতি জানান দেয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ গত সাড়ে ১৫ বছরে যতভাবে সম্ভব শেখ মুজিবকে উপস্থাপন করলেও একটিবারের জন্যও ‘মুজিববাদ’ উচ্চারণ করেনি। তারপরও ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ কেন? মুক্তিযুদ্ধে বা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবের নাম-চিহ্ন মুছে দেবার উদ্দেশ্যে? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্মারক ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করবার যে প্রবণতা সম্প্রতি নানা দিক থেকে প্রকাশ্য; তারই কোনো ধারাবাহিকতা কি এই স্লোগান? চব্বিশের আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান– ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা/ দেশটা কারও বাপের না’। সেই লাখো শহীদের রক্তস্নাত দেশে মুক্তিযোদ্ধারা যে নেতার নামে স্লোগান দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন; তাঁর নামে আজ দুয়োধ্বনির আয়োজন মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে অন্য ইস্যুকে সামনে আনবার চেষ্টা বলে মনে হয়।
আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে; মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়েছে; জবাবদিহিতা না থাকায় রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। আওয়ামী লীগের এসব ব্যর্থতার কারণেই শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে মানুষ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। এসব ব্যর্থতা নিয়ে এনসিপির কোনো বিশ্লেষণ বা অবস্থান আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে এনসিপির কোনো নেতার বক্তব্য আমাদের চোখে পড়ে না। অবশ্য ক্ষমতার অলিন্দে থাকলে কখনোই কোনো দল বা নেতা গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতার প্রয়োজন বোধ করেন না। এনসিপি কি ক্ষমতার অলিন্দে?
৩.
গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এনসিপির সমাবেশে হামলা করলে সংঘর্ষ বাধে। পরিণতিতে সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণ ও প্রাণহানি। এই সরল বিবরণে যে মস্ত বড় প্রশ্নটি মাথা তুলে দাঁড়ায়– পুরো ঘটনায় সরকার কী করল? এক দলের নেতাকর্মীরা আরেক দলের নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে; এই যুধ্যমান পরিস্থিতি গোপালগঞ্জে তৈরি হতে পারে– এটি সরকার আগে থেকে জানে না; তা বিশ্বাস করা কঠিন। সরল সত্য হচ্ছে, গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ রোধে সরকার আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আবারও সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাল মানুষ। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী পুলিশের হাতে এভাবেই প্রাণ হারিয়েছে মানুষ।
দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কি আনতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার? শুধু এ প্রশ্ন কেন, কোনো প্রশ্নেরই উত্তরের জন্য বর্তমান সরকারের উপযুক্ত কাউকে কোথাও পাওয়া যায় না। বিশেষত ড. মুহাম্মদ ইউনূস– গত বছর ৮ আগস্ট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি সংবাদ সম্মেলনেও অংশ নেননি। একটি দেশের সরকারপ্রধানকে সে দেশের সাংবাদিকরা সরাসরি প্রশ্নের সুযোগ পান না। হায়, গণতন্ত্র!
অবশ্য নিন্দুকেরা বলতে পারেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রশংসাবাজির মহোৎসব করতেন। ড. ইউনূস নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা নন; গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য যে গণঅভ্যুত্থান, তিনি সেই অবিস্মরণীয় আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকারপ্রধান হিসেবে আসীন; তারপরও তিনি সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেন না। সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধানের উপস্থিতি জাতির সামনে জীবন্ত বার্তার উৎস; গণতান্ত্রিক দেশে এই সংস্কৃতি নিয়মিত। সংসদ কার্যক্রম চলমান না থাকলে এটি আরও বেশি জরুরি; আমাদের দেশে বর্তমানে সংসদ নেই, সরকারপ্রধান বিদেশে গিয়ে সে দেশের সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেন; দেশে তিনি সাংবাদিকদের কাছে লভ্য নন।
ক’দিন আগে ঘটে যাওয়া মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ড; সেটা ভুলিয়ে দিচ্ছে গোপালগঞ্জে সরকারি গুলিতে মানুষের প্রাণহানি। দেশ খুনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুনের সব রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। তবু সরকারের পক্ষ থেকে প্রণিধানযোগ্য ব্যাখ্যা বা সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রতিটি ঘটনার পর টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে যা বলেন, তা বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের অযৌক্তিক কথামালা স্মরণ করায়।
আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্বে ব্যর্থতার পাশাপাশি স্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ প্রসঙ্গে নীরব থেকেও সরকার নানা সংশয় সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়– এ রকম একটু আওয়াজ নানা দিক থেকে তোলা হচ্ছে। এই সংশয় মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। সরকারের দোদুল্যমানতা ও নিশ্চুপ অনুপস্থিতি বিরাজমান পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। এ অবস্থায় সরকারপ্রধানের বার্তা ও নির্দেশনা সরাসরি ও সুস্পষ্ট হওয়া জরুরি। যাবতীয় অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে দ্রুত নির্বাচনের দিকে তিনি দৃঢ়সংকল্পে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন– রক্তঝরা এ দেশের মানুষের আপাতত এর চেয়ে বড় চাওয়া নেই। সংঘর্ষ, অসহিষ্ণুতা অবসানের জন্য গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রথম সোপান।
আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.