আহমেদ সোহেল (বাপ্পি) :
ঢাকার ফার্মগেট। রবিবার দুপুর। এক পিলার থেকে হঠাৎ ঝরে পড়া ভারী বিয়ারিং প্যাডে থেমে গেল ৩৫ বছরের আবুল কালাম আজাদ নামের এক পিতার জীবন। মুহূর্তে নিভে গেল এক পরিবারের আলো—দুই ছোট্ট শিশুর বাবা হারিয়ে গেলেন।
এই মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি অবহেলার ফল, একটি পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতীক। রাষ্ট্রের প্রকল্প, সরকারের তত্ত্বাবধান, প্রকৌশলী, অফিসার, নিরাপত্তা পরিদর্শক—যাদের দায়িত্ব ছিল নিয়মিত ফিটনেস ও সেফটি চেক, তাদের গাফিলতিই কেড়ে নিলো এক মানুষের জীবন, এক পরিবারের ভবিষ্যৎ। দায় এখানেই।
কালামের জীবনের শেষ রাতের ফেসবুক পোস্টে লেখা ছিল— “ইচ্ছে তো অনেক। আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।” পরের দিন তিনি সত্যিই চলে গেলেন—চিরতরে।
তার স্ত্রী বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, “আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা আছে, তাদের কে দেখবে! আজকে আমি বলছিলাম বের হইও না।” কীভাবে তিনি বাচ্চাদের বুঝাবেন? বাবা যে আর ফিরবে না, তা কীভাবে বোঝাবে সেই ছোট্ট মুখগুলোকে, যারা প্রতিদিন বাবার গলায় ঝুলে খেলতো?
ফার্মগেটের মানুষজন বলছেন—“এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা অবহেলা।” আমরাও জানি, এই এক কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রের নীরব নিষ্ঠুরতা। তারপর এল সংবাদ—দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৫ লাখ টাকার অনুদান এবং পরিবারের একজন কর্মক্ষম সদস্যকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শুনতে ভালো লাগে, দেখতে সুন্দর লাগে, কিন্তু আমরা সবাই জানি—এটা কেবল গতানুগতিক রাজনৈতিক কৌশলের ইমোশনাল মার্কেটিং ছাড়া কিছু নয়।
এই ঘোষণা আসল সমস্যার সমাধান নয়; এটি কেবল দায়িত্বের বোঝা হালকা করার একটি পুরনো নাটক।
আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলব না, কারণ আমরা জানি—এই দেশের ইতিহাসে কোনো মন্ত্রী লজ্জিত হয়ে নিজ থেকে পদত্যাগ করেননি। লজ্জা এখানে কেবল মৃতদের পরিবারের জন্য, যারা জানে এই সিস্টেমের কাছে জীবনের দাম কতটা কম।
এখন সময় এসেছে মুখস্থ শোকবার্তা বা আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতির নয়—দায় নেওয়ার।
রাষ্ট্রকে জবাব দিতে হবে, এই প্রকল্পে নিরাপত্তা প্রটোকল মানা হয়েছিল কিনা, নিয়মিত ফিটনেস চেক করা হয়েছিল কিনা, সেই রিপোর্ট কোথায়।
যদি না হয়, তবে দোষীদের শাস্তি চাই—নির্বাচন বা দল নয়, ন্যায়বিচারের নামে।
আর আমরা, সাধারণ মানুষ, আর শুনতে চাই না “দুর্ঘটনা ঘটেছে”—আমরা শুনতে চাই “দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে।”
কোন সনদ না, ক্ষমতায় যাওয়ার কোন খায়েশ না, না কোন দলীয় পদ-পদবী, না কোন উন্নয়ন—
জরুরী ভিত্তিতে এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে।
মরা মানুষের কি লাভ উন্নয়নের রাজনীতিতে ? সব কিছু তোমরা নিয়ে নাও, বিনিময়ে মানুষকে জীবন বাঁচাতে দাও। দেশটাকে মৃত্যুপুরী থেকে বাঁচাও। আর একটা মৃত্যুও দেখার মতো শক্তি আমাদের শরীরে অবশিষ্ট নেই। আর একটাও কবর খোঁড়ার সামর্থ্য আমাদের নাই।
মানুষ আমিও—এত ছোট শিশু, বাচ্চা, বৃদ্ধ, বাবা-মায়ের কান্নাভরা মুখের দিকে তাকানোর মতো শক্তি আর নেই। প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা, যার যায় সে-ই বোঝে এর ভার। আবুল কালামের স্ত্রী এখন কেবল চোখে জল আর বুকে এক প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন—“আমার দুইটা বাচ্চাকে এখন কে দেখবে?”
আহারে দেশ, আহারে এ দেশের মানুষের জীবন।প্রতিবারের মতো আবারও একটি মৃত্যু, কিছু কাগজ, কিছু প্রতিশ্রুতি—তারপর সব ভুলে যাওয়া।
।। লেখক- মানবাধিকার কর্মী, গবেষক ও পর্যবেক্ষক।
আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.