রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর দুর্ঘটনাস্থলে উদ্ধারকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ভীত-সন্ত্রস্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, উদ্বিগ্ন অভিভাবক ভিড় করেছিলেন। উদ্ধারকৃতদের যখন বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন ছিল উপচে পড়া ভিড়। আহতদের যখন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, সেখানেও ভিড় কমেনি। নিহতদের দেহ পরিবার-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পরিস্থিতি একই।
বস্তুত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার অহেতুক ঢল এক পরিচিত চিত্র। এমনটা দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে ভবন বা অগ্নিদুর্ঘটনার পরও। কোনো দুর্ঘটনা হলে সেখানে অবস্থানকারী নিকটজনের মধ্যে উৎকণ্ঠা থাকবে এবং তারা দুর্ঘটনাস্থলে ভিড় করবেন; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎসুক জনতার অহেতুক উপস্থিতি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় যে ব্যাঘাত ঘটাবে, এটাও সহজে অনুমেয়।
সোমবারের দুর্ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে একই চিত্র। ফলে ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকর্মীদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা এবং আহতদের হাসপাতালে পৌঁছানো রীতিমতো দুরূহ ছিল। তাই দুর্ঘটনাস্থলে নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, যেমন রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউট ছাড়া অন্যরা যাতে ভিড় করতে না পারে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হতো। সাধারণ মানুষকেও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে যে কোনো দুর্ঘটনাস্থলে উদ্ধার কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করা যায়।
যে কোনো দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ও তথ্য সরবরাহে কে মুখপাত্র, তা এক দীর্ঘদিনের অস্পষ্টতা। সোমবারের দুর্ঘটনায় কোনো কোনো উপদেষ্টাকে কথা বলতে শুনেছি, যিনি বা যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। একজন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রয়োজনে আহতদের বিদেশে চিকিৎসা করা হবে।’ অথচ তাঁর মন্ত্রণালয় এ দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।
আমার মতে, এ দুর্ঘটনা-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো হচ্ছে প্রতিরক্ষা (বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা বিবেচনায়), স্বরাষ্ট্র (উদ্ধার কার্যক্রমে ফায়ার সার্ভিস এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব বিবেচনায়), স্বাস্থ্য (আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা বিবেচনায় ও শিক্ষা (দুর্ঘটনাস্থল ও দুর্ঘটনার শিকার স্কুল বিবেচনায়)। অথচ সোমবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করিনি। অন্যদিকে কোন মন্ত্রণালয় এ দুর্ঘটনা-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার ফোকাল, তা বরাবরের মতোই অস্পষ্ট।
প্রসঙ্গত, সরকারের এসওডি বা দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলিতে দুর্যোগের সংজ্ঞা অনুসারে সোমবারের দুর্ঘটনাকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত ছিল। তাহলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় হতো ফোকাল মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হতেন সংশ্লিষ্ট কমিটির প্রধান।
সোমবারের দুর্ঘটনাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার নির্বিঘ্ন, দক্ষ সমন্বয় ও তথ্য বিভ্রাট এড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা দপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত; যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বা তাঁর প্রতিনিধি মুখপাত্র বিবেচিত হবেন। সরকারের চলমান এসওডি সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত।
অনেকেই জনবহুল এলাকায় বিমান প্রশিক্ষণের যথার্থতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পড়লেও শুধু পাইলট এবং অল্প ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনাস্থলে অবস্থানকারী সীমিতসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। কারণ সেসব প্রশিক্ষণ হয়েছে ঢাকার বাইরে। সম্ভবত এবারই প্রথম জনবহুল এলাকায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্বের অনেক দেশ অনেক আগেই তাদের প্রধান বিমানবন্দর বড় শহর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। যেমন কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট ৬০ কিলোমিটার, ব্যাংকক এয়ারপোর্ট ৩০ কিলোমিটার দূরে। মনে আছে, আশির দশকে তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর কুর্মিটোলায় স্থানান্তর হলে সমালোচনা হয়েছিল– এত দূরে বিমানবন্দর! কারণ তখন উত্তরা শহর গড়ে ওঠেনি। আমাদের অদূরদর্শিতায় দেশের প্রধান বিমানবন্দরটি এখন অবস্থিত জনবহুল এলাকায়; যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত– ভাবা যায়! যেহেতু উত্তরা শহর স্থানান্তর সম্ভব নয়, তাই বিমানবন্দর ঘিরে এখনই ভাবার সময়।
এম. এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
halim_64@hotmail.com
লেখালেখি থেকে আরো পড়ুন